Friday 29 November 2013

"ব্যোমকেশ ব্যোমকেশ" খেলা

লিখব কি লিখব না সেটাই ভাবছিলাম, শেষ পর্যন্ত ভাবলাম দেশটা তো স্বাধীন আর আমিও। তাই লেখাই যায়, যদিও অনেকে এতে রাগ করবেন, গাল দেবেন কিম্বা হীন-মস্তিস্কের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেবেন। কোনদিন এর আগে ছায়াছবি নিয়ে লিখিওনি, অনেকবার ভেবেছি, কিন্তু হয়ে ওঠেনি। অথচ আজ প্রবনতাটা এতই প্রবল হল যে বসেই পড়লাম। আর বসে যখন পড়েছি তখন পেটের মধ্যে যেটা গজগজ করছে সেটা উগরে দিই। 

সম্প্রতি একটি বাংলা ছবি দেখলাম। বরেন্য, সংবেদনশীল পরিচালক স্বর্গীয় শ্রী ঋতুপর্ণ ঘোষ মহাশয়ের শেষ ছবি। নাম- সত্যান্বেষী। এবং ঠিক এখান থেকেই আপত্তির শুরু। ওই নামে এই কাহিনীর মুখ্য চরিত্র এবং বাঙালির অতি প্রিয় ব্যোমকেশের একটি জলজ্যান্ত গল্প থাকা সত্ত্বেও পরিচালক নিজের ইচ্ছামত অন্য একটি অতি জনপ্রিয় গল্পের নাম বদলেছেন এবং দর্শক প্রথম থেকেই বিভ্রান্ত হতে শুরু করেছেন। যে গল্পটি নিয়ে এই ছবি, তার নাম- "চোরাবালি"। জানি না পরিচালক মহাশয় কি ভেবে এই পরিবর্তনটি করলেন, কারণ শুধু নামেই তিনি থেমে থাকলেন না। কাহিনীর চরিত্রেরা- মুখ্য গৌন নির্বিশেষে কিরকম যেন পাল্টে গেল। পরিচালক মহাশয় বরাবরই গল্পের নায়িকাদের বিশেষ সম্মান দিয়ে থাকেন, এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। মূল গল্পে তাই যে দুটি মহিলা চরিত্রের শুধুমাত্র নামোল্লেখ আছে, ছবিতে তারাই মুখ্য জায়গা দখল করল। এবং তারপরে শুরু হল আসল খেলা, প্রেম-শরীর-বিছানা থেকে যেন বেরোতে পারলেন না পরিচালক। তাই গল্পটি আর শরদিন্দুবাবুর রইল না, একান্তই ঋতুবাবুর হয়ে উঠল। এতটাই রং বদলাল সে, যে অপরাধের কারণও পরিবর্তিত হয়ে গেল মূল গল্প থেকে, ঋতুবাবু নতুন ব্যোমকেশ লিখলেন। আর বলার অপেক্ষা রাখে না, সেটি গ্রহনযোগ্য নয়, বিশেষত এটি যখন একটি গোয়েন্দা-কাহিনী এবং পূর্বে বহু-পঠিত।  এতই নতুন গল্প উপহার দেওয়ার বাসনা থাকলে বোধ করি উনি অন্য নামের একটি গোয়েন্দা বানালে ভালো করতেন, বাঙালির আবেগে সুড়সুড়িটার প্রয়োজন ছিল না।

ছবিটির কোনদিকই দেখলাম না, যেখানে তাকে একটু প্রশংসা করা যায়। কিন্তু বিশ্বাস করুন, চেষ্টা করেছিলাম, খুঁজেছিলাম। আমিও আপনাদের মতই পরিচালক মহাশয়ের একজন গুনগ্রাহী, আর তাই কেন জানি না সন্দেহ করতে শুরু করেছি। আদৌ ছবিটি শেষ করেছিলেন তিনি? শুধুই কি post-production, নাকি অনেক কিছুই তিনি নিজে করেন নি? কারণ ছবিটিতে ঋতুপর্ণসুলভ কিছুই নেই। পোশাক এবং অন্দরসজ্জা ছাড়া আমি আর কোনো বিষয় দেখতে পেলাম না যেখানে এটিকে কষ্ট করেও ঋতুপর্ণের ভাবনা বলে মনে করতে পারি। ছবি শুরু থেকেই শ্লথ, ভীষণভাবে জরাক্লিষ্ট। সংলাপও তথৈবচ। "বৈতংসিক ব্রাহ্মন" জাতীয় দু-একটি সংলাপ বাদ দিলে ছবিটিতে গবেষণাও কিছু নেই। নেই শরদিন্দু কল্পিত অসামান্য প্রকৃতি-বর্ণনা। যে শুষ্ক-নদীখাত আর জঙ্গলের আলো-ছায়া কাহিনীর অন্যতম suspense, সেটিও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ছবি থেকে নির্বাসিত।

আর কি বিরক্তি-উত্পাদক অসহ্য অভিনয়! সুজয় ঘোষ সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল যে তিনি খুব বুদ্ধিমান এবং বড় মাপের পরিচালক, কিন্তু এটা কখনই ভাবিনি যে তিনি অভিনয়ের অ-ও বোঝেন না। তাঁর কাজকে তাই under-acting বললেও ভুল হবে। অনিন্দ্য চন্দ্রবিন্দু-সুলভ হাসি থেকে বেরোতে পারলেন না। কালিগতি, বৃদ্ধ-রাজা, হরিনাথ, পুরোহিত ইত্যাদি চরিত্রে অভিনেতাদের অভিনয় ফুত্কারে উড়ে যাওয়ার মত। সেই তুলনায় দেওয়ান চরিত্রটি বিশ্বাসযোগ্য। আর এখানেই দ্বিতীয় সন্দেহ। পরিচালক আদৌ পরিচালনা করেছেন? তাহলে অভিনয়টা করল কে? ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত এবং অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় এখানে একটু সাহায্য করেছেন। অন্তত এঁদের জন্য বসে ছিলাম ছবিটার শেষ অবধি। কিন্তু সেটাই ভুল ছিল, শেষে যা সত্য অন্বেষণ করলেন 'সুজয় বক্সী', তা মূল গল্পের তুলনায় এতই পৃথক যে পরিচালকের সব চেষ্টা জলে গেল।

নড়বড়ে সম্পাদনা বলতে যা বোঝায়, এই ছবিটি তার text book example, তবে ক্যামেরা ভাল। ছবির আবহ নিয়ে বলার কিছু নেই, অসম্ভব খাপছাড়া এবং শ্রুতিকটু বললে কম বলা হয়। তার উপরে ব্যবহারেও খামতি আছে, অপ্রয়োজনীয় দৃশ্যে আবহ আছে, প্রয়োজনে নেই। সর্বোপরি ছবির special effects, এতই দুর্বল যে বিস্ময়ের স্থানে তা শুধুমাত্র হাসির উদ্রেক করে। সাম্প্রতিক হিন্দি ছবিগুলির থেকে কি কিছুই শেখা যায় না এই ক্ষেত্রে? একটি জায়গাতেই মুন্সিয়ানা, তা হল ছবির প্রচারে এবং promo নির্মানে। আর সেখানেই বিভ্রান্তির শুরু, ভালোলাগার শেষ।

সবশেষে এক কথায় এটাই বলার যে পরিচালক মহাশয় এই ছবিটি নিয়ে "ব্যোমকেশ ব্যোমকেশ" খেলতে গিয়েছিলেন শুধু, ছবি বানাতে চান নি, অন্তত ছবিটি শেষ হবার পর তাই মনে হয়।অবশ্য আদতে যদি এটি তাঁর ছবি হয়ে থাকে!

1 comment:

  1. Boddo kora somalochona hoye geche to. Jai hok, sotti eta bahu protikkihito chobi chilo. Dorshoker anek ashao chilo. Jodio ekhono amar dekhar soubhagyo hoye otheni, tabuo dekhar iche ta ache. Dekhar por ei review ta arekbar porbo.

    ReplyDelete