মুখুজ্যেদার বাড়িতে এলে এটাই হয়। একদিন আড্ডা মারব বলে আসা হয়, থেকে যেতে হয় দু-তিনদিন। আড্ডা চলতে থাকে, সাথে খাওয়া দাওয়া তো আছেই। মানে শুক্রবার সন্ধ্যেবেলা এলে রোববারের আগে পাততাড়ি গুটোনোর নাম নেই কারও। মুখুজ্যেদা বলে ওরাও নাকি তাই করত ওদের সিনিয়রদের বাড়ি গেলে।
কালকের সন্ধ্যের ঐ ঘনঘন কারেন্ট যাওয়ার কারন পরে জানা গেল, কমপ্লেক্সের কোনো একটা ফেজে গোলমাল ছিল, তাই বিদ্যুৎ দপ্তর থেকে লোক এসেছিল মেরামত করতে। তারাই ভুল করে অন্য ফেজ নিভিয়ে ফেলাতে বিভ্রাট ঘটছিল। এটা শুনে সুমন আবার স্বমহিমায় ফিরে এসেছে। সে যাই হোক গে, ব্যাটা কাল দোপেঁয়াজাটা রেঁধেছিল খাসা। আসলে এই দায়িত্বটা বেশিরভাগ সময়ে আমাকেই নিতে হয়, যেখানেই যাওয়া হোক না কেন, আমাকেই রান্না করতে হয়। অবশ্য আমার রাঁধতে খারাপ লাগে না। কিন্ত কাল বৌদি আর সুমন ভাগ করে রান্নাটা করে নেওয়ায় আমি পার পেয়ে গেছিলাম। আমরা তাসটা পেড়ে খেলব বলে ভাবছি, মুখুজ্যেদা বলল “ঋষভ, আজ বেশ বৃষ্টি হচ্ছে, কারেন্টটাও বারবার যাচ্ছে, আজ বরং গপ্পোই চলুক। তাস নাহয় কাল খেলা যাবে। কি বলিস?”
বোঝা গেল মুখুজ্যেদা মুডে আছে গল্প বলার। আর কেউ তাস খেলে? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম “এ তো দারুন প্রস্তাব। কিন্ত তোমাকেই শোনাতে হবে। আমার ভান্ডার ঢুঁ ঢুঁ।” মুখুজ্যেদা হাল্কা না না করে রাজি হয়ে গেল। বিনয় আর কি! ইতিমধ্যে মঙ্গল উঠে গিয়ে আরেক রাউন্ড চা করে এনেছে। নাড়ু তাড়াহুড়ো করে খেতে গিয়ে জিভ পুড়িয়েছে। গৌরব হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছে। আমি বললাম, “কি গো, শুরু করো।” “হ্যাঁ, এটাও প্রায় বছর পাঁচেক আগের গল্প” মুখুজ্যেদা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে শুরু করল।
“আমি তখন সবে চাকরি জয়েন করেছি। প্রথমবার নিজের হাতে সংসার চালাচ্ছি। এতদিন পুরোটাই বাবা মার উপর ছিল, এই প্রথম টাকার হিসেব থেকে কাজের লোকের মাইনে, নিউজপেপার থেকে মাসকাবারি সব করতে হচ্ছে। তবে মন্দ লাগছে না। প্রথম তিনমাস কোম্পানি থাকতে দিয়েছিল, তারপর ফ্ল্যাট দেখে উঠে যেতে হবে। আমি কয়েকদিন খুঁজে পেতে একটা বেশ ভাল ফ্ল্যাট যোগাড় করলাম। বেশ খোলামেলা, পুবের আলোও আছে আবার দক্ষিনের বাতাসও। লিফ্ট আছে, বাড়িওলা ভাল, ঝামেলা করে না। ভাড়াটাও খুব বেশি না।আর কি চাই?”
“শুনে কতকটা এই ফ্ল্যাটটার মতই মনে হচ্ছে, তাই না?” ফুট কাটল নাড়ু। “ঠিক বলেছিস”, মুখুজ্যেদা বলে চলল “তো আমি এসে উঠলাম সেই ফ্ল্যাটে। প্রথম রাতটা ভালই গেল, কোনো অসুবিধে হল না। এত ক্লান্ত ছিলাম জিনিসপত্র বয়ে যে পড়েছি আর মরেছি। পরদিন অফিস গেলাম, ফিরলাম। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে একটা সিনেমা দেখতে বসলাম। তখন আমার বেলা দশটা থেকে অফিস, সুতরাং শোবার তাড়া নেই। সিনেমাটা তখন প্রায় শেষের পথে, রাত সোয়া বারোটা হবে বোধ হয়, হঠাৎ স্পষ্ট শুনলাম কেউ যেন বেডরুমে হাল্কা কেশে উঠল। আমি বুঝতে পারছি আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় আমাকে সতর্ক করে দিচ্ছে যে কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটছে। গায়ের রোমকূপগুলো জানান দিচ্ছে আমি চরম সজাগ হয়ে পড়েছি। কিন্ত বুঝতে পারছি না উঠব না ওভাবেই বসে থাকব। এই ভাবতে ভাবতে কতক্ষণ পার হয়েছে জানি না, আবার চটকা ভাঙল দ্বিতীয়বারের জন্য কাশির আওয়াজে। না, এভাবে বসে থাকা যাবে না। ল্যাপটপটা গুছিয়ে উঠে হল থেকে বেডরুমে ঢুকলাম। আলো জ্বাললাম। আমার নতুন পাতা চাদর টানটান করা বিছানাতে একটা বড় ফড়িং। দু চারবার হাত নাড়তেই সেটা উড়ে প্রথমে বেড সাইড টেবিল, তারপর টেবিল ল্যাম্প হয়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি পুরো ফ্ল্যাটটা ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে যখন শুতে গেলাম তখন দুটো বাজছে। ঘুম ভাল হল না, স্বপ্ন দেখলাম একটা খোঁড়া বুড়ো লাঠি হাতে কাশতে কাশতে আমার দিকে দৌড়ে আসছে আর আমি বাঁচার জন্যে পালাচ্ছি।”
“এটা সেই বিয়েবাড়ির ভুতের সাথে ক্রশ হয়ে গেছে” নাড়ু বলল। “তাই হবে”, মুখুজ্যেদা আবার শুরু করল “পরের দিন আমি আর চান্স নিই নি। খেয়ে দেয়েই বিছানায়। ভাল ঘুম হওয়া খুব দরকার। আর শোবার কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমটা এসেও গেল। ভাঙল আবার একটা অস্বস্তিতে। কেউ যেন আমাকে ডাকছে, অনেক দূর থেকে, কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করছে। চোখটা খুলতেই জানলার বাইরে চোখ গেল। আজ বোধ হয় অমাবস্যা বা তার পরের দিন। আকাশটা একদম কুচকুচে কালো। কিচ্ছু ঠাহর করতে পারলাম না। একটু চোখ সইতে বুঝলাম বাইরে রাস্তার আলোগুলোও জানি না কেন নিভে গেছে। আস্তে আস্তে চোখ ফিরিয়ে ঘরের ভেতর আনলাম। ঘড়িটা চলছে, দেয়ালে আজ সন্ধ্যেবেলা লাগানো লাদাখের পোস্টারটা আবছা বোঝা যাচ্ছে। পাখাটাও চলছে..... আরে ওটা কি!!!”
“কি হল? কি দেখলে” মুখুজ্যেদার ব্রেকটা একটু লম্বা হতেই মঙ্গল ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সুমন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। বৌদিকে ডাকছে। কিছুতেই একা যাবে না।
“যেটা দেখলাম সেটা কতটা বলে বোঝাতে পারব জানি না। তবু চেষ্টা করছি। সিলিঙে পাখার দিক থেকে একটু পাশের দিকে চোখ যেতেই দেখলাম একটা মুখ। অদ্ভুত, বিশ্রী, অপার্থিব একটা মুখ। ব্যস, আর কিছু নেই। শুধু একটা মুখ। সেটাকে মুখ বলার কারন তাতে দুটো চোখ, একটা নাক আর একটা মুখগহ্বর আছে। কিন্ত কোনোটাই মানুষের মুখের মত নয়। চোখগুলো ভয়ানক লাল, বিশাল বড় বড়, পাতা পড়ছে না, সেগুলো দিয়ে যেন কতকালের জিঘাংসা ফুটে বেরোচ্ছে। নাক বলতে শুধু দুটো ফুটো। মুখের কষ দিয়ে লালা ঝরছে। বীভৎস সেই মুখটার জায়গায় জায়গায় ক্ষতের দাগ। অন্ধকার ঘরে কি উপায়ে যেন সেই মুখের উপরে এক চিলতে আবছা আলো এসে পড়েছে। সেই আলোতে আরো বীভৎস হয়ে উঠেছে ঐ মুখ। যেন অন্ধকার থাকলেই ভাল হত, ঐ মুখ দেখতে হত না। মূহুর্তের মধ্যে হাত পা অবশ হয়ে গেল। আর কি এক অদৃশ্য টানে আমার চোখদুটো আটকে রইল ঐ মুখের উপর। অনেক চেষ্টা করেও চোখ সরাতে পারলাম না। হঠাৎ একটা অদ্ভুত শব্দ শুরু হল কোথা থেকে। কেউ যেন গোঙাচ্ছে। গলা টিপে ধরা হয়েছে কারো, আর সে চেষ্টা করছে বাঁচতে, চেঁচিয়ে কাউকে ডাকতে। কিন্তু তার গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না, বেরোচ্ছে ঐ বিশ্রী গোঙানি। আর গোঙানির সাথেই ঐ মুখটা ঘুরতে শুরু করল সিলিঙে। আস্তে আস্তে নেমে আসতে লাগল আমার দিকে। শরীরের সব শক্তি এক জায়গায় এনে আমি প্রাণপনে চেষ্টা করে চলেছি বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে পালাতে কিন্তু কোন এক অশরীরী যেন আমাকে বেঁধে রেখেছে তার অদৃশ্য হাত দিয়ে। মুখটা নামছে ধীরে ধীরে, যখন আর কয়েক হাতের তফাৎ, চলতে থাকা গোঙানিটা স্পষ্ট হয়ে উঠল- “আয়, কাছে আয়, আমায় বাঁচা, আমায় বাঁচা”।
কে কাকে বাঁচাবে! মুখটা তখন আর একটু মাত্র ব্যবধানে। খেয়াল করলাম, মুখটা ভাল করে দেখলে তাতে একটা মানুষের আদল আছে। আর সেটা পরিবর্তিত হচ্ছে, একটা মুখের আদল বদলে তৈরি হচ্ছে অন্য একটা মুখ। এখন ক্ষত বা বিস্ফারিত চোখগুলোকে অগ্রাহ্য করে দেখতে চাইলে ভেতরের আসল মানুষটাকে চেনা যেতে পারে। খুব চেনা চেনা লাগছে না? এ মুখ আমার কোথায় যেন দেখা। ঐ বীভৎস বাহ্যিক কলুষতা ছাড়া এ মুখ আমার ভীষণ চেনা। বাইরে মেঘ করেছে, গুমোট আবহাওয়া, হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে উঠল। আর সাথে সাথেই চিনতে পারলাম মুখটাকে। একে আমি রোজ সকালে দেখি, ঘুম থেকে উঠে, ব্রাশ করতে করতে, আয়নায়। হ্যাঁ, আমার নিজের মুখ! কোনো এক অপার্থিব জাদুবলে ঐ মুখের পেছনে আসলে আমার মুখটাই রয়েছে। কি করে জানি না কিন্ত মনে হচ্ছে যেন আমাকে গ্রাস করতেই ঐ মুখটা আমার মুখের আদলে সেজে নিল!
আমি কাঠ হয়ে পড়ে আছি, দুচোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। মনে মনে বুঝতে পারছি এটাই আমার শেষ রাত। কাল ভোরের আলোটা আমার জন্যে ফুটবে না। আমার পরিনতিও হবে ঐ মুখটার মত। নি:শেষ হয়ে যাব আজ রাতে। তারপর অনেকদিন পরে এই ঘরে থাকতে আসা কারো মুখের আদলে সাজবে মুখটা। আমার খোলস ছেড়ে পরবে তার মুখের খোলস। শেষ সময়টা খুব কাছে, হয়ত আর কয়েকটা মিনিট, তারপরে আমার বিলীন হয়ে যাবার চরম মূহুর্তটা আসছে। মৃত্যু কেমন জানি না। কিন্তু হঠাৎ খুব শীত করছে আমার। ধ্রুবনীল মৃত্যু যেন ধেয়ে আসছে দুহাত বাড়িয়ে। সম্মোহিতের মত তাকিয়ে রয়েছি মুখটার দিকে। মুখটা আর মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে।
হঠাৎ জোরে জোরে কলিং বেল বেজে উঠল। মুখটা যেন দাঁড়িয়ে পড়েছে, আর নেমে আসছে না। কিরকম একটা থতমত খাওয়া ভাব। আবার বেল বাজছে। একটু থেমে এবার বেজেই চলল। আমার শক্তি ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। নিজেকে কোনোমতে গুটিয়ে যখন বিছানা থেকে নামতে যাচ্ছি লক্ষ্য করলাম মুখটায় একটা অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে, হতাশা, অবজ্ঞা আর ভবিষ্যতের সাবধানবাণী মিশিয়ে সে অভিব্যক্তি যেন আমাকে বলছে “কবার পার পাবে? কাল রাতে দেখে নেব”। ও যেন আশা করে নি এই এত রাতেও আমার বাড়ি কেউ আসতে পারে।
একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের দরজায় পৌঁছলাম। দরজাটা খুলতেই সামনে শাশ্বত। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে এবার ওর অবাক হবার পালা। “কি হলরে? ভুত দেখছিস নাকি? আমি রে! ভুলে গেছিস নাকি? তোকে যে পরশু ফোন করেছিলাম, আমি আসব! আমার জয়েনিং কাল! দেখ না.. ফ্লাইটটা এত লেট করল!”
আমি ততক্ষণে ওকে জড়িয়ে ধরেছি। আমাকে বাঁচাল ও। নাহলে এতক্ষণে যে কি হত! ঘুম ছুটে গিয়েছিল, ওকে সব খুলে বললাম। প্রথমে তো ও মানতেই চাইল না, পরে আমার সিরিয়াসনেস আর ফ্যাকাশে মুখ দেখে কিছুটা বিশ্বাস করল। আমি স্হির করে নিলাম এ বাড়িতে আর একটা রাতও নয়। সকাল হতেই অফিস ভুলে নতুন ফ্ল্যাট দেখে অ্যাডভান্স করে চাবি নিয়ে মাল পাঠানোর কাজ শুরু করলাম। বাড়িওয়ালা এরকম ভাড়াটে আগে দেখেনি। শাশ্বতকে মেসেজ করে দিলাম নতুন বাড়ির খবর। বিকেলে যখন নতুন ফ্ল্যাটে ক্লান্তদেহে বসলাম শেষমেশ, স্বস্তির নি:শ্বাস বেরোল একটা।”
- “সেই ফ্ল্যাটটা কোথায়?” প্রশ্ন করল মঙ্গল।
- “এটার তিনটে ফ্লোর উপরে”
- “মানে, একদম ভার্টিকালি তিনটে ফ্লোর উঠলেই সেটা পাওয়া যাবে?” এবার গৌরবের জিজ্ঞাসা।
- “আজ্ঞে, আর মুখটা কিন্তু নিচের কে নামে!”
- “কি বলছ! আবার এখানেও এসেছিল নাকি?” সুমনের গলায় স্পষ্ট ভয়।
- “নাহ্ তা আসে নি। মনে হয় ও ঐ ফ্ল্যাটেই আটকে আছে।”
- “ওখানে এখন কেউ থাকে না?” আমি প্রশ্ন করলাম।
- “না। আমার আগেও অনেকদিন খালি ছিল, আর এই ক’বছরেও কেউ আসে নি। আসলে আমি ঐ বাড়িওয়ালাকে এত ঝেড়েছিলাম আর বাজারে কথাটা এত রটে গেছে যে আর কেউ ওখানে থাকার সাহস করে নি”
- “কিন্ত এটা বললে যে ওটা নিচের দিকে নেমে আসে। তুমি শিওর তো যে ওটা ঐ ফ্ল্যাট থেকে বেরোতে পারে না?” সুমন রীতিমত চিন্তিত।
- “না রে বাবা। তা নাহলে আমি এখানে থাকতে পারতাম!”
সবাইকে চমকে দিয়ে ঝনঝন করে বেলটা বেজে উঠল। অর্ডার করা স্টার্টারগুলো এসে গেছে।