Friday 4 March 2016

মুখুজ্যে মহিমা: শকট সংশয়

অনেকদিন হলো পেটের মধ্যে কথাটা কিলবিল করছে। না পারছি গিলতে না পারছি বলতে। বলতে না পারার কারণ হলো চরম লজ্জা। আর গিলতে না পারার কারণটা ....... না হে, এভাবে বলা যাবে না। দাঁড়াও বাপু, তাহলে খুলেই বলি।

গাড়ি এসেছে, দু একটি বিক্ষিপ্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা বাদ দিলে আমি বেশ ভালই চালাচ্ছি।ভালো মানে এই ধর বাজার করতে যাচ্ছি (অবশ্যই মলে, কারণ প্রকৃত অর্থে যাকে বাজার বলে সেখানে গাড়ি নিয়ে যাবার ধৈর্য বা সাহস কোনটিই আমার নেই), অফিসে যাচ্ছি, পাশের পাড়ায় রিহার্সাল দিতে যাচ্ছি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কথায় আছে না, খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হলো তার হেলে গরু কিনে, আমার হলো তাই।

একদিন শখ হলো পাওয়াই যাব। আসলে জায়গাটার সাথে এমনিতেই একটা পুরনো সম্পর্ক আছে, তার সাথে আবার আমার এক বন্ধু সবে পিতৃত্ব লাভ করেছে এবং তার স্ত্রী ও সদ্যোজাত শিশুপুত্র পাওয়াইয়ের একটি হাসপাতালে আছে। তা চললাম অফিসের পর, সাথে আছে দুই বন্ধু, ঝামেলা কিছু হবে না। গাড়ি চলল গড়গড়িয়ে। অফিস থেকে বেরিয়ে সদর রাস্তা ধরে তারপর যানজট পার করে খাঁড়ির সেতু পেরিয়ে মূল মুম্বাই শহরে তো পৌছে গেলাম। উফ, কি যে আত্ম-গৌরব আর ততোধিক আনন্দ সে আর কি করে বলব। আমার সাথে যে দুই বন্ধু ছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন আমার সাথেই গাড়ি শিখেছিলেন। তিনি কিন্তু এখনো এতদূর গাড়ি আনেন নি। তাই তাঁর সামনে আমি তখন বামনরূপী শ্রীবিষ্ণু। পেট থেকে তিন নম্বর পা বের করে বাকি দুই বন্ধুর মাথায় রেখে আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু পথ তখনও বাকি ছিল।

এক্সপ্রেসওয়ে ধরে আমার গাড়ি পাওয়াই পৌছল। উঁচু নিচু ফ্লাইওভার ধরে আমার সেই প্রিয় পুরনো শহরতলি। পেটের ভেতর কবিতা গুঁতো মারবে মারবে করছে এমন সময় ঘটনাটা ঘটল। সামনে একটা গাড়ি, সাদা রং এর মারুতি সুইফট ডিজায়ার। বেশ ছুটছিল, হঠাত সিগনাল দেখে "গঁত" করে বেঁকে দাঁড়িয়ে গেল। আর আমিও টাল সামলাতে না পেরে ইংরেজি ছবির মত দিয়েছি সেটাকে ঠুকে। ব্যাস, আর যায় কোথায়!

রাস্তায় যানজট, চারিদিক থেকে ভেঁপু বাজছে, লোকজন চেঁচাচ্ছে, আর সামনে থেকে স্বয়ং যমরাজ হেঁটে আসছেন। আমি আর কি বলব, পটল দিয়ে সিঙ্গি মাছের ঝোল খাওয়া বাঙালি, হাত পাগুলো পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যাচ্ছে। এমন মুখ্যু, যে জানালার কাঁচটা পর্যন্ত বন্ধ করি নি। যমরাজ এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। মানে জানালা দিয়ে হাত ঢোকালেন, গাড়ি থেকে চাবি খুলে নিলেন এবং অশ্রাব্য গালি দিয়ে নিজের গাড়িতে চড়ে  বসলেন। আমাদের তো মাথায় হাত। "দৌড় , দৌড়"... তাঁর কাছে গিয়ে দেখি আর এক কান্ড। তাঁর পত্নীদেবী সামান্য আহত হয়েছেন আমার ঠোক্করে, আর যমরাজ আমায় গালি দিয়েই চলেছেন। অনেক কষ্টে তাঁদের বোঝাই যে আমি শিক্ষানবিশ মাত্র, আমার কোনো উদ্দেশ্য ছিলনা তাঁর গাড়িতে ধাক্কা মারার। দেবী তবু একটু নরম, তাঁর কথাতেই আমরা চললাম নিকটস্থ হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে যাবতীয় কাজকর্ম, দেবীর তাত্ক্ষণিক চিকিত্সা ইত্যাদির খরচ বহন করলাম। যমরাজ কিন্তু বকেই চলেছেন, এমনকি মাঝে মাঝে শাসাচ্ছেন যে তিনি কোনো এক বিখ্যাত দৈনিক এর সম্পাদক এবং চাইলে কালই আমার নামে কেস ঢুকে দেবেন এবং আমাকে মিডিয়া দিয়ে উত্যক্ত করে তুলবেন। আমি তো তাঁর গাড়ির ক্ষতি শুধু করিনি, তাঁর স্ত্রীর আঘাত লেগেছে, আর তাঁকে পাঁচদিন গাড়ি দোকানে রাখতে হবে, তাঁকে গাড়ি ভাড়া করে অফিস যেতে হবে, তাতেও বেজায় খরচ। তখনও বুঝিনি এ আমি কার পাল্লায় পড়েছি, যদিও বোঝা উচিত ছিল

যমরাজের পিতাশ্রী এলেন, বৌমাকে নিয়ে বাড়ি গেলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছিল, আমি সহজ উত্তর দিলাম মুখ কাঁচুমাচু করে যে নতুন গাড়ি চালাচ্ছি তাই ব্রেকের জায়গায় এক্সেলারেটার চেপে ফেলেছি। তিনি খুবই দয়াপরবশ হয়ে বললেন, "হতেই পারে। যাক গে, বেশি কিছু হয়নি সেটাই রক্ষে।" বৌদিমনিকে যারপরনাই বিনয়ে বললাম আমায় ক্ষমা করে দিন আমার অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য, তিনিও বললেন, "না না ঠিক আছে"। কিন্তু তারপর যা বললেন, সেটি ভয়ংকর, "আমি তো কিছু বলছি না, কিন্তু আমার স্বামী লোকটি মাথাগরম, যান, ওঁকে  শান্ত করুন"

বলে কি! শান্ত করুন মানে? উনি কি সত্যি যমরাজ নাকি তান্ডব নাচা মহাদেব!

বৌদিমনি যে ভুল বলেননি, সেটা প্রমান হল শ্বশুর আর বৌমা বাড়ি যাওয়ার পরে। যমরাজ আরেকজনকে ডেকে আনলেন, ইনি ছোট যমরাজ। বয়সে ছোট কিন্তু তেজে অনেক বড়। ইনি পাওয়াই অঞ্চলে একজন ছোটখাটো প্রোমোটার এবং এনার সবার সাথে ওঠাবসা, সে পুলিসই হোক বা গুন্ডা। কিন্তু আমরা তো তখনও সেসব জানি না। তিনি এসে দাবি করলেন "দুই পেটি দে"। ও বাবা, সে আবার কি কথা! ভর সন্ধ্যেবেলা খামোখা মাছ কিনে ওনাকে পেটিটাই দিতে যাব কেন? তিনি বুঝলেন আমরা অবোধ বালক বালিকার দল এবং সেখানেই আমাদের... বাকিটুকু উহ্য থাক

আমাদের প্রায় খামচে ধরে টেনে নিয়ে চললেন স্থানীয় থানার দিকে। আমরা বুঝলাম এরা টাকা চাইছে। পাঁচ-দশ হাজারে রফা করব, প্রায় ঠিক করে ফেলেছি আমরা নিজেদের মধ্যে। ভয়ে ভয়ে ওনাদের বলতেই হাসির রোল উঠলো। "তোরা বড় বড় কোম্পানিতে চাকরি করিস, আর পাঁচ-দশ হাজারের কথা বলছিস!" কে ওদের বোঝাবে যে বাইরে থেকে যা মনে হয়, আসল সত্যিটা তার উল্টো! লোকে যখন ভাবে আমি কুয়ালালামপুরে শপিং করছি আমি তখন আসলে কদমতলায় কচু তুলছি।

থানা যে কি বিচিত্র জায়গা, সেদিন বুঝলাম। এ দেশে  টাকার জোর ভয়ানক বস্তু। বড় এবং ছোট যমরাজ পর্যায়ক্রমে পুলিস বাবাজিদের কানে মন্ত্র দিয়ে চললেন, এবং সেটিও স্তরে স্তরে উর্ধপদাবলম্বনে। এবং আশ্চর্যের কথা হলো পুলিস বাবাজিরাও কী সুন্দর টোপটা  গিললেন। আমাকে একখানা লম্বা পাতা ধরানো হল। আমার অসাধারণ মারাঠি বিদ্যেয় তার মানে হল এরকম: "আমি অন্যায় করেছি। এবং তারপর ভীষণ মনোকষ্টে ও বিবেক দংশনে ভুগে আত্মসমর্পণ করতে এসেছি"। বোঝো কান্ড! সে আমি তো কিছুতেই সই করব না, আর তারাও ছাড়বে না। এদিকে সময় বহিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়

আমাকে বলা হল বাড়িতে ফোন করতে। আমি বললাম, সে করুন, কিন্তু যেই বাড়ির ঠিকানা শুনলো হাওড়া, দ্বিতীয়বার আর "বাবাকে বলে দেব" গোছের শাসানির উল্লেখ করলো না। বুঝলাম এইভাবে আমাকে ভয় দেখিয়ে টাকা বের করতে পারছে না। আর ঠিক তার পরেই দিল মোক্ষম দাওয়াই। একখানা অন্ধকার ঘরে আমাকে দিল পুরে, আবছা আলোয় বুঝলাম আরেকজনকে বেঁধে রাখা আছে সেখানে, চেয়ারের সাথে দড়ি দিয়ে! ভাবুন অবস্থাখানা! আমি যত চেঁচাই, তত দরজার কাছে মুখ এনে দর দস্তুর করতে থাকে। দুই লাখ  থেকে কমতে কমতে দেড়, এক পঁচিশ, এক অবধি তো এলো কিন্তু আর কমে নামতে চায় না। 

বুঝতে পারছেন? এখনো চলছে সেই অত্যাচার। বিকেলবেলায় যে দুর্ঘটনাটি শুরু হয়েছিল, সেটি এই রাত সাড়ে  দশটাতেও শেষ হয়নি। আমি সত্যি সত্যিই আর পারছি না। খিদের চোটে  আমার নাড়িভুঁড়ি হজম হবার জো, পিলের ব্যথায় চোখে অন্ধকার দেখছি, আর এই দুই যমরাজ মুদির দোকানের দর দস্তুর চালিয়েই যাচ্ছে। আমার তখন বন্ধ হয়ে আসা চোখের পেছনে একটা নরম বিছানা আর গরম গরম ভাতের ছবি নাচছে। ধেত্তেরি নিকুচি করেছে তোদের দর দস্তুর! বল, কত টাকা চাই তোদের? তোর্  দাম, তোর্  ভাইয়ের দাম, তোর্  গাড়ির ক্ষতির দাম, তোর্  পাঁচ দিনের হয়রানির দাম.... বল কত লাগবে? খুব বুঝতে পারছি যে, এই যমরাজ আসলে আমার স্বপ্নে দেখা ধর্মরাজ এর আত্মীয় নন, ইনি স্রেফ মৃত্যুদাতা, পরবর্তী ধর্মের বিচারের ধারে কাছে দিয়ে এনার যাতায়াত নেই। যে মানুষ স্ত্রীর হালকা আঘাতে পুরস্কার পাওয়ার মত অভিনয় করতে পারে, এবং ঠিক তার পরেই স্ত্রীকে বাড়ি পাঠিয়ে পুলিসকে সাথে নিয়ে আমার সাথে দর সস্তুর করতে পারে, সে আর যাই হোক, সোজা মানুষ নয়। 

আর এই দিব্যজ্ঞান লাভের পরেই আমার সংসার, জীবন, যন্ত্রণা ইত্যাদি যাবতীয় জাগতিক বিষয় থেকে মোহ শেষ হয়ে গেল (না, মানে সেই নরম বিছানা আর গরম ভাতটা  বাদে)। টাকা দিলে এই রাক্ষসদের থেকে ছাড়া পাওয়া যাবে? তো দে টাকা। পরশু বোনাস পেয়েছি না? "দেখুন দাদা, আমার কাছে এই পঁচাশিই আছে, এর বেশি নেই। নিতে হয় নিন, নাহলে আমি আর পারব না।" যেন নিমরাজি হয়েছে, এমন একটা ভাব করে বলল দাও আগে। বন্ধুদের পাঠালাম এ টি এম থেকে তুলতে, কারণ একজনের কার্ডে তো এত বেরোবে না। চোখের সামনে টাকার ভাগাভাগি হল, দেখলাম এবং জ্ঞানার্জন করলাম। আমাকে মুক্তি দেওয়া হল রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ

তারপর? তারপর আর কি? এখনো আপনারা পড়ছেন গপ্পোটা?এতক্ষণে তো মনে মনে আমাকে গালাগালি দিয়ে "বোকা" ইত্যাদি বলেছেন নিশ্চয়ই! সে বলুন, আমার দুক্ষু হবে না। শুধু একটা ব্যাপারে আমি খুশি থাকব যে, টাকার মায়া আমাকে বশ করতে পারল না আমাকে আমার সুখী গৃহকোণে ফিরে আসতে, একটা রাতের জন্যও না। এর অনেক পোস্টমর্টেম হতে পারে, অনেক ব্যাখ্যা, অনেক যুক্তি আসতে পারে, কিন্তু আমার সত্যি কিচ্ছু যায় আসে না। কারণ আমি এই ঘটনাটাকেও একটা শিক্ষা ছাড়া অন্য কোনো নাম দিতে পারি না। 

পুনশ্চ: তা বলে ভাববেন না যেন যে আমি এখনো গাড়ি চালাতে শিখিনি। কি, বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা ঠিক আছে, নিজে একবার এসে পরখ করে যান। সামনের রোববার সকালবেলা কি করছেন? যাবেন নাকি একটা লং ড্রাইভে?




আজ ফিরি বাড়ি

শিরশিরে হাতে ঘুম ভাঙিয়েছে ভোর
আলো নেই আজকের সকালবেলায় 
অসময়ে ধূসরের ছোঁয়া পাওয়া দিন 
টেনে নিয়ে যায় মন ইচ্ছে খেলায় 
ধুলো নিয়ে ছোট ছোট ঘূর্ণির দল
মনের গলির মাঝে ঘোরে ইতি উতি  
একডাকে ছুটে আসা কুকুরের মত 
ফোঁটা ফোঁটা শুরু হল, থাক বর্ষাতি
ত্রস্ত কাকের দল কা কা ডাকে ঝড়
দৌড়ে পালাতে গিয়ে পড়ে যাওয়া লোক
গুমোটের মেঘ কেটে ফুরফুরে হাওয়া 
আজকের দিনটা খুব ভালো হোক
গাছের পাতায় আজ বান ডেকে আনে 
মাতাল হাওয়ার সাথে ছেঁড়া এক ঘুড়ি
আজ তবে থাক সব পড়ে যে যেখানে
আজ তবে থাক সব, আজ ফিরি বাড়ি