Wednesday 29 August 2012

মুখুজ্যে মহিমা: শকট সংবাদ

আবার একটা কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে অনেকদিন ধরে, বাংলাতে। কিন্তু রম্যরচনা জিনিসটা এতই কঠিন যে দুম করে একটা লিখে ফেলব তার জো নেই।দেখো বাপু, হাসব না, লিখব, কিন্তু লোকে হাসবে পড়তে পড়তে। অনেকটা সেই হাসির নাটকে অভিনয় করার মত।ইস্কুলে ওরকম কত হয়েছে। রিহার্সাল দিয়ে দিয়ে সবাইকে উত্যক্ত করে করে যেদিন আসল অভিনয়, সেদিন মঞ্চে উঠে ডায়ালগ বেরোনোর জায়গায় বেরোচ্ছে এতদিনের লুকিয়ে রাখা হাসি। কি বিশ্রী ব্যাপার। কিন্তু মাথায় তো কিছু একটা আসতে হবে, তবে না লিখব। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই ঔপন্যাসিকরা কিভাবে এত লেখে বল তো! একটা কিছু ভেবে (অথবা না ভেবেও) সেটাকে ঘেনিয়ে পেনিয়ে দীর্ঘায়িত করতেই থাকে। ক্লান্তি ব্যাপারটা যেন পাঠকের থাকতে নেই। হাতে গোনা গুটি কয়েকজন আছেন যাঁদের লেখা ধরলে ছাড়া যায় না। কিন্তু নিজেকে সে জায়গায় ভাবতে শুধু ভয় না, সন্দেহ হয়!

যাক সে সব কথা।আজ একটা নিজের গপ্প বলি। হঠাত একদিন ইছে হল গাড়ি কিনব। বাইক ব্যাপারটা আমার দ্বারা হবে না, সেটা আগেই বুঝেছিলাম। তাই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ চারচাকাটাই মনে ধরল। কিন্তু কি গাড়ি? ওরে বাবা, সে এক কঠিন অভিজ্ঞতা।আমার চার পাশের লোকজন গাড়ি নিয়ে যে এত জানে, সেটা সেদিনই প্রথম জানলাম।অনেকের অনেক  মতামত, উপদেশ ইত্যাদির ধাক্কা সামলিয়ে নিজের পছন্দ মত একটা ছোট গাড়ির অর্ডার দিলাম। তারপর অপেক্ষা, দীর্ঘ অপেক্ষা। যেন শ্রীরাধিকা পোড়ামুখ কানাইয়ের জন্য রাত জেগে বসে আছেন। সে আর আসে না। বন্ধু বান্ধব শুধোয়, পাড়া পড়শী জিজ্ঞাসা করে, আমি শুধু হাসি। আসবে, সে আসবেই। তারপর একদিন এলো। গাড়ি নয়, খবর। "আপনার পছন্দ মত রং নেই স্যার। লাল চলবে?" আর চলবে! তখন রাধিকার প্রাণ ফাটে ফাটে অবস্থা, "চলবে", বলে দিলাম। তারপর সে সত্যিই এলো।



টুকটুকে ছোট্ট লাল গাড়িটাকে দেখে সত্যি দারুন আনন্দ হল। ইতিমধ্যে আমি গাড়ি শেখার ইস্কুলে ভর্তি হয়েছি এবং প্রাত্যহিক জীবন শুরু করেছি শিক্ষকের সুমধুর কটুক্তি শুনে। এরকমও শুনেছি যে আমার দ্বারা কোনদিনও গাড়ি চালানোটা হবে না, অযাচিত সাচ্ছল্য এবং সময়ের প্রাচুর্যের কারণেই আমি গাড়ি শিখছি। যাই হোক, এ সমস্ত অর্বাচীন কথাতে কর্ণপাত না করে আমি অসীম ধৈর্যের সাথে গাড়ি চালানো শিখেছি।গাড়ি এলে তাকে পুজো করাতে হয়। একে তাকে ধরে তেলটা  ভরিয়ে আনলাম।কিন্তু পুজো করাতে কে নিয়ে যাবে? শিক্ষক বলেছিলেন শুরু শুরুতে রাতে একদম বেরোবেন না।আগে কনফিডেন্স আসতে দিন। তাই চেনা দু-একজন বন্ধুকে চেষ্টা করলাম। একজনকে পাওয়া গেল। মন্দির যাওয়া হল, পুজো দেওয়া হল। বাড়ির কাছেই এক কালী মন্দির। বাঙালি যেখানেই যায়, একটা দুর্গাপুজো, একটা কালিবাড়ি আর একটা নাটকের দল বানায়। তাই এ পরবাসে কালী মন্দির খুব একটা বিচিত্র নয়, বরং বলা যেতে পারে বেশ সহজলভ্য।চোখ পিটপিট করতে করতে মাকে অনেকবার বললাম "দেখো মা, রক্ষে কোরো।" মা বোধ হয় সেদিন একটু বেশি ব্যস্ত ছিলেন। মন্দিরে প্রচুর লোক তো, রাম নবমী বলে কথা।

পরদিন সকালে ঘুমটা ভাঙ্গলো বেশ তাড়াতাড়ি। উসখুস করছি সকাল থেকে উঠে। একটা কিরকম বদহজমের ভাব। নিশপিশ করছে আঙ্গুলগুলো। অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলাম, কাল তেল ভরা হয়ে গেছে, কোথাও যাবার নেই, মেলা কাজ আছে ঘরে। তবু কিসের একটা অদৃশ্য টান টেনে নিয়ে চলল গ্রাউন্ড ফ্লোরের দিকে।চাবিটা ঘুরিয়ে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকে তবে একটা ঢেকুর উঠলো। বেশ লাগছে।যাব নাকি গেটের বাইরে? এখন তো রাস্তায় ভিড় নেই। আসতে আসতে চালালে মনে হয় না কোনো বিপদ হবে। আর চিন্তাই সর্বনাশের মূল।

গেট থেকে বেরিয়ে পড়লাম। রাজকীয় হস্তিসদৃশ দুলকি চালে আমার গাড়ি শহর প্রদক্ষিণে বেরোলো।বাড়ি থেকে বেরিয়েই বাঁদিকে যেতে হবে বড় রাস্তাতে যেতে হলে। প্রানপনে স্টিয়ারিং ঘোরালাম, গাড়ি ঘুরল বাঁই করে। অতি বোদ্ধার মত মনে পড়ল একে বলে পাওয়ার স্টিয়ারিং। পাওয়ার বটে! ধীরে ধীরে পা গুনতে গুনতে বড় রাস্তা এগিয়ে আসতে লাগলো, আর একটু একটু করে আমার কনফিডেন্স এর পারদ চড়তে থাকলো। হেঃ! কে বলে আমি গাড়ি চালাতে পারব না? হর্ন বাজিয়ে গাড়ি বড় রাস্তাতে পড়ে বাঁদিকে চললো। একি, এরকম তো হবার কথা নয়। এত গাড়ি কেন রাস্তাতে আজ? বুঝতে পারছি নিজের হাতে স্টিয়ারিং থাকলে রাস্তাটাকে মেলার মত লাগে।কচ্ছপের মত চলছি, পাশ দিয়ে একটা গাড়ি বেরিয়ে গেল হুশ করে। যাবার সময় কি যেন একটা বলেও গেল। বলুক গে যাক, আমার শুনে কাজ নেই। নিজের মত চললেই হল। আবার একটা মোড়। স্টিয়ারিং ঘোরানো যে এত কঠিন কাজ তা জানতাম না। ওদিক থেকে একটা অটো দুরন্ত বেগে এগিয়ে আসছে।আমি বাঁদিকে যাবার চেষ্টা করছি। অটোটা কি বেআদপ, এগিয়েই আসছে। হঠাত ব্রেক কষলো। আমি কিন্তু পারিনি। প্রমাদ গুনতে গুনতে দেখলাম সিনেমাতে দেখা স্লো মোশনের মত আমার গাড়ি অটোটাকে হালকা ছুঁয়ে দিয়ে  দু-এক পা গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল। থামতে আমি চাইনি, কিন্তু তবু থেমে গেছি, আর কিছুতেই স্টার্ট দিতে পারছি না। এদিকে  অটোওয়ালা ছুটে এসেছে, তার সাথে তার কয়েকজন সঙ্গী। বিশ্রী ব্যাপার। হম্বি তম্বি করছে। আমার মনে হচ্ছে, এদের টাকা চাই। আর সত্যি কথা হল ঠিক তাই ই। আমার চালক হিসাবে অক্ষমতা, পিতার উদাসীনতা, সম্পদের প্রাচুর্য, মানুষের জীবনের দাম সম্পর্কে আমার অবহেলা ইত্যাদি গম্ভীর বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর উক্ত অটোওয়ালা এবং তার সঙ্গীরা পাঁচশো টাকা জরিমানা ধার্য করলেন। অনেক অনুনয়, নতুন গাড়ির দোহাই দিয়ে শেষমেশ দুশো টাকাতে রাজি হলেন তারা। হাত কাঁপছে, স্টিয়ারিং ধরব কি! এবার ফেরার পালা। শিরদাড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইছে, কোনমতে টেনেটুনে বাড়ি ফিরছি। কত কি যে ভাবছি, গেট এসে গেল। যাক, অনেকটা নিশ্চিন্ত।

কিন্তু ভোগান্তি তখনও বাকি ছিল। নিশ্চিন্ত হয়ে দিলাম গাড়ি মেজাজে গেটের ভেতর ঢুকিয়ে। মর মর করে আওয়াজ। ওয়াচম্যানের সাইকেল। গেটের পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা ছিল, দিয়েছি একদম পাড়িয়ে। সে বেচারা কার্টুনে দেখানো  পাড়িয়ে যাওয়া পাঁপড় হয়ে গেছে। অতঃকিম! আরো পাঁচশো টাকা দক্ষিনা দান। সাইকেলের মেরামতির বিস্তর ঝামেলা সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং অবশেষে নিস্তার। লিফটে উঠতে গিয়ে মনে মনে বললাম, "মুখুজ্যে, তোমার আর গাড়ি চালানো হল না।"  

3 comments:

  1. bravo...chorom hoyechhe!! chaliye jaaaaaaaaa..........aro chai!!

    ReplyDelete
  2. Eto sohoje hal charben na, chalie jan borda. bere hoyeche lekhata :)

    ReplyDelete