Thursday 14 December 2017

মুখুজ্যে মহিমা: মিষ্টি মুখ ১

"আঃ, লাগছে, আর পা ছুঁড়িস না, কি হলো শুনতে পাস্ না নাকি?"

কে শুনবে? তিনি তখন স্বপ্নের জগতে। দিব্যি চার পা আকাশের দিকে তুলে মোটামুটি নিত্যানন্দ পোজে শিবনেত্র হয়ে সুপ্ত। হ্যাঁ , চারটেই পা। আমার মিষ্টি বুড়ি।

মিষ্টি আমার মেয়ে, গায়ের রংটা বেশ চাপার দিকে, কানগুলো অত্যধিক  ঝোলা, মেয়ে হয়েও গায়ে ভয়ঙ্কর বেশি লোম, সারাক্ষন জিভ বের করে থাকে, প্রচন্ড হ্যাংলা। আমরা কিছু খেলেই সামনে এসে বসে আর মুখ থেকে অনবরত নাল পড়ে। কিন্তু চোখদুটো এতো মায়াবী যে না দিয়ে থাকা যায় না। আর তারপরেই তার আনন্দ দেখে কে! ল্যাজ নেড়ে গোল গোল ঘুরতে থাকে। মিষ্টি আমার আড়াই বছরের লাসা আপসো কুকুর। অবশ্য ওকে অন্য কেউ কুকুর বললে মোটেই সহ্য করি না, বেশ একহাত নিয়ে নিই।

তা যে কথা বলছিলাম, রাত দুপুরে ঘুমের মধ্যে লাথি খেতে কার ভালো লাগে বলুন? কিন্তু আমাকে খেতে হয়, রোজ, আমার বৌকেও। কারণ মিষ্টি মাঝরাতে খাটে উঠে দুজনের মাঝে ঠেলে ঠুলে ঢুকে পড়ে, আর তারপর ঘুমের ঘোরে অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড করে। তার মধ্যে লাথি মারাটা খুব বেশি। ধরুন সেদিনের কথাটাই, বেশ আয়েশ করে একটা বিয়েবাড়ির স্বপ্ন দেখছিলাম, ফিসফ্ৰাই, নানপুরী আর ছোলে সাঁটিয়ে সবে পোলাও আর মাংসে হাতটা দিয়েছি, ব্যাস! কে যেন ছোঁ মেরে হাত থেকে মাংসের টুকরোটা নিয়ে হাওয়া, আর তলপেটে সজোরে একটা লাথি। কে আবার! আমার কন্যা।

খুব রাগ হলো, ঘুমের মধ্যে চোখ কচলে বেটিকে ধরে খাট থেকে নামিয়ে দিলুম। সে বেচারিরও তো কাঁচা ঘুম চটকেছে। খুব অবাক হয়ে খানিক্ষন মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর গুটি গুটি আমার পাশের দিকের মেঝেতে শুয়ে ফোঁপাতে লাগলে! সত্যি বলছি, মা ঘেঁটুকলির দিব্যি, ফোঁস ফোঁস করে সে কি কান্না! আবার তাকে তুলে এনে পাশে শোয়াই, ব্যাস, আর যায় কোথায়! আমার বালিশের উপর ঠ্যাং তুলে দিয়ে আমার শোবার জায়গাটা প্রায় পুরো দখল করে নিয়ে সোজা ঘুম। আমি আবার বেঘর।

তা এ হেন মিষ্টির একদিন ভারী সাধ হয়েছে সন্ধ্যেবেলা তিনি বাইরে হাওয়া খেতে যাবেন! প্রসঙ্গত, সেদিনের কোটা কমপ্লিট! ঘুরে আসা হয়ে গেছে, কিন্তু কেউ যদি ভুলেও ওনার সামনে "চলো" কথাটা উচ্চারণ করে, মিষ্টি পাগল হয়ে যায়। আমার সীমিত জ্ঞান অনুযায়ী, কুকুর দেড়শো থেকে দুশো শব্দ বুঝতে পারে, মানে ওই শব্দগুলি ওরা এক একটি বিশেষ কাজের সাথে জুড়ে নিজের মতো করে বোঝে। যেমন ধরুন কুকুরকে "আয়" বললে ওরা কাছে আসে, "যা" বললে পালায়, সেরকম! মিষ্টির জীবনের প্রিয়তম ও সবচেয়ে আকর্ষণীয় শব্দ হলো "চলো"। তা মিষ্টির সেদিন সন্ধ্যেবেলা আবার বাইরে যাবার ভুত মাথায় চাপলো। তাকে কিছুতেই তখন শান্ত করা যায় না! বাড়িতে যে বন্ধুরা এসেছে, তারাও ঠিক সেই সময়েই বেরোবে, মিষ্টি প্রায় তাদের জামা কাপড় কামড়ে ধরে ঝুলতে শুরু করেছে, "নিয়ে চলো না একবার প্লিজ"। আমার বন্ধুরাও অপ্রস্তুত!

এগিয়ে এলো আমার বৌ, "কোথাও যাবে না এখন, যাও টেবিলের নিচে যাও"। বাহ্ রে! কোথায় বাইরের পার্ক আর কোথায় টেবিলের তলা! কোথায় বাইরের ফেতি কুকুরগুলো আর কোথায় একটা পুরোনো সফ্টটয়! মিষ্টির বয়ে গেছে টেবিলের নিচে যেতে! সে নেচেই চলেছে, কখনো দু ঠ্যাঙে, কখনো আবার দু হাত লাফ মারছে! আমার বন্ধুরা বেরোতেই পারছে না। আমার বৌ শেষমেশ চেপে ধরলো মিষ্টিকে, ওদের যে দেরি হয়ে যাচ্ছে! কোনোমতে ওরা বেরোতেই দরজা বন্ধ করে তাকে ছাড়া হলো। আর একছুট্টে মিষ্টি বেডরুমে! আমি  বললাম,"দেখলে তো? কি রাগ করেছে!" বৌ বললো "করুক যে, সবসময় সব কথা শুনতে হবে নাকি?"

আর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না তেনার, আমরা টিভি দেখছি, সময় যাচ্ছে! এদিকে রাতের খাবারের সময় হয়ে আসছে, মিষ্টির দেখা নেই! আমি বেশ কবার ডাকলাম, সাড়া  নেই। এমনিতে সাড়া না দিলে মিষ্টিকে বিভিন্ন নামে আর বিভিন্নভাবে ডাকতে হয়, সেসবও করা হলো, তিনি আসেনই না। এবার আমার বৌয়ের সন্দেহ হয়েছে! "এরকম তো করে না", দেখে আসি একবার!"

ভিতরে গিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম, কখনো ভুলবো না। মিষ্টি খাটের উপরে জানালার দিকে তাকিয়ে বসে আছে, অপলকে,ল্যাজটা  একদম নেতিয়ে ঝুলে আছে, সামনে গিয়ে দেখি, দু চোখ বেয়ে জলের ধারা! কি বলব, মুখে ভাষা জোগালো না। কথা বলল বৌ, দেখি তার চোখেও জল, "মিষ্টি চলো", সঙ্গে সঙ্গে দু'পা তুলে জিভ বের করে মিষ্টি রাজি। মানুষ আর কুকুরে সবচেয়ে বড় তফাৎ বোধ হয় এটাই, একবার আদর করে কাছে ডেকে নিলে মিষ্টি সব ভুলে আরো কাছে চলে আসে।

পরের দৃশ্য: ডিনার ভুলে আমরা কপোত কপোতী মিষ্টির সাথে দৌড়ে বেড়াচ্ছি পার্কে, মিষ্টি উর্দ্ধশ্বাসে ছুটছে একটি নেড়ি কুকুরের পিছনে, সে বেচারি ভয়ে কোথায় লুকোবে বুঝতে না পেরে কেউঁ কেউঁ শব্দ সহযোগে পলায়নরত, আর আমরা দুইজন অসহায় হয়ে চেঁচাচ্ছি "মিষ্টি, মিষ্টি, এক্ষুনি এদিকে আয়, আজ তোরই একদিন কি আমারই একদিন!"


Friday 27 October 2017

চতুর্থ বাঁকের পরের রাস্তাটা

এলোমেলো হাঁটছি এখন,
গড়িয়ে গড়িয়ে নুড়ির মত।
মত্ত পায়ে ঠোক্কর খাচ্ছি আর খুঁজছি
চতুর্থ বাঁকের পরের রাস্তাটা।
যখন হাঁটা শুরু করেছিলাম
সেই আধ ঘন্টা আগে বোধ হয়,
কিংবা ঘন্টা দুয়েক,
মনে করতে পারছি না এখন আর-
স্মৃতি তালগোল পাকিয়ে কাদার মত থকথকে হয়ে উঠছে।
যা বলছিলাম, যখন হাঁটা শুরু করেছিলাম
খুঁজছিলাম একটা ঠিকানা,
অথচ পাচ্ছিলাম না-
কেউ একজন এগিয়ে এসে বলেছিল,
চতুর্থ বাঁকের পরের রাস্তাটা নিতে হবে।
তারপর থেকে খুঁজে চলেছি,
কতগুলো বাঁক গেলে পরে চতুর্থ বাঁকটা পাব-
মনে পড়ছে না আর এখন।
নেশা কেটে যাচ্ছে বারবার,
তবু চার দেয়ালের মধ্যিখানে ঘুরছি,
একই জায়গায়
একই বৃত্তের ভিতর,
চতুর্থ বাঁকের পরের রাস্তাটা খুঁজে পাচ্ছিনা।
খুঁজে দেবেন আমায়?