Friday 22 November 2013

আধ-হজমের উদগিরণ বা বাঙালির কাব্য-চর্চা

কবিতা লেখা বেশ একটা বড় রকমের বদভ্যাস। আমি বিশ্বাস করি (এবং চারিপাশে অনবরত দেখি) যে প্রত্যেক বাঙালি জীবনের কোনো না কোনো একটা সময়কাল জুড়ে কবিতা লেখে বা লেখার চেষ্টা করে। না, আমি এই প্রবণতাকে খারাপ বলছি না। বরং এ এক রকমের অহংকার। এ হলো স্বভাব কবি বাঙালির স্বাভাবিক কবিত্ব প্রকাশের পূর্বনির্ধারিত প্রস্ফুটন অথবা সংস্কৃতিপ্রেমী জাতির প্রতিভার বিচ্ছুরণ। তাই এতে আমার বিরুদ্ধ মতবাদ প্রকাশ করার কোনো জায়গা নেই। তাহলে "বদভ্যাস" কেন বললাম? সেখানে উপযুক্ত কারণ আছে এবং সেই কারণ সকলের জানারও প্রয়োজন আছে। পাঠক ভাবতে পারেন আমিও আঁতলামি করছি। ভাবুন, ক্ষতি নেই, তবু নিজের ভাবনাটা আপনাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারছি এই অনুমানেই আমার আনন্দ। 

কবিতা অতি পবিত্র জিনিস। আদিকবি পক্ষীদম্পতির মিথুনকালে হত্যার আয়োজনে অতিশয় কষ্টভোগে প্রথম কাব্য রচনা করেন। তাই প্রথম কবিতা দুঃখের কবিতা। এবং কিমাশ্চর্যম! সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিও জীবনে প্রথম কবিতা লেখে প্রেমে দাগা খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে উঠে। কখনো সে আঘাত এতই দুর্বিষহ মনে হয় যে বাঙালি প্রেমিক (অথবা প্রেমিকা) কবিতা লিখেই চলে। পাতার পর পাতা ভরে উঠতে থাকে অনির্বচনীয় কষ্টের দিনলিপিতে। এবং সেখানেই আমার প্রথম যুক্তি। আদৌ কি সেগুলি কবিতা? নাকি তার নাম ধার করে বুকের ভেতরে জমে থাকা, গিলতে বা হজম করতে না পারা প্রেম-অম্বলের ঢেঁকুর? তাহলে তাকে কবিতা নাম দিয়ে কবিতার অপমান করি কেন? হতে পারে, এই পরিস্থিতিতেও কবিতার জন্ম অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তার মধ্যে কাব্যগুণ থাকা আবশ্যক। কে নির্ণয় করবে? কবি নিজে

 দ্বিতীয় যুক্তি অন্তমিলে। একটা সময় ছিল যখন সবাই ছন্দে কবিতা লিখত এবং কবিতার রীতি ছিল তাই। কিন্তু তারপর এলো ছন্দহীন সময়। সুর-তাল কেটে গেল চারিদিকে। আর সাহিত্য যখন সমাজের প্রতিফলন, তখন কবিতা কেন ধরে রাখবে তার ছন্দ? সময় এলো পরিবর্তনের, কবিতা ছুটল নিজের মত করে। কারো ধার সে ধারে না। প্রথমে একটু আলোড়ন হলো, তারপর ছন্দহীন কবিতা সর্বগ্রাসী হয়ে বাকিদের গিলে খেল। রাক্ষসী যেন! আমার কোনো ধারা নিয়েই আপত্তি নেই। দুরকম কবিতাই আমার ভালো লাগে, যদি সেটা আদতে কবিতা হয়। এবং আমার মনে হয়, পাঠকেরও তাই লাগে। তাহলে জোর করে ছন্দ জুড়ে বৃথা প্রয়াস কেন ভাই? ভাবটাকে নিজের মত করে কথায় সাজিয়ে দাও না কেন-- তাহলেই তো একটা রূপ খাড়া হয়ে ওঠে। সেখানেও অসুবিধা আছে, অল্প বয়সে বাঙালি ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করে, আর একটু বড় হয়ে রবীন্দ্রনাথ-কল্লোল-জয় গোস্বামী-শ্রীজাত পার করলেই ছন্দহীন বিজাতীয় বিসদৃশ শব্দমালা সাজাতে থাকে প্রানের আনন্দে।

তার না আছে মাথা, না আছে মুন্ডু। চারটি ভিন্নধর্মী, তিনটি খাপছাড়া, দুটি ইংরাজি আর একটি ফ্রেন্চ বা ইতালিয়ান শব্দ পাশাপাশি বসিয়ে দিলেই ব্যাস -- আর পায় কে! এবারের অমুক পুরষ্কার আমার বাঁধা। আজকাল এই দিকটার চর্চাই বেশি হচ্ছে। যে যত বেশি দুর্বোধ্য শব্দ-সম্মেলন রচনা করবে, সে তত বড় কবি। কাব্য সমালোচকরা তো আরো এক কাঠি সরেস, তারা এমন এমন মানে বের করবেন, যা হয়ত কবি কেন, কবির অন্তরাত্মাও কোনদিন কল্পনা করতে পারেন নি

আর সবচেয়ে মারাত্মক হলো শেষ প্রকার। এই দল ভাবেন যে তাঁরা যা করবেন, তাতেই তাঁরা সেরা। সত্যি, বাঙালির এই রবীন্দ্রনাথ -বিভ্রম যে কবে যাবে! করছ বাপু রাজনীতি, খামোখা কবিতা লিখতে যাও কেন? তবু বারণ শুনবেন না এঁরা, লিখেই যাবেন এবং প্রতিদিন লজ্জা দেবেন। আবার কিছু লোক আছেন, যাঁরা এঁদের প্রতিভার প্রতি চরম আস্থা রেখে প্রতিদিন উত্সাহ দিয়ে যাবেন। বেনাবনে মুক্তা ছড়ানো, জাতীয় ফুটবল দল এ উত্সাহ পেলে উতরে যেত! কিছু করার নেই

অনেকক্ষণ জ্ঞান দিলাম। কিছু মনে করবেন না ভাই, কাজ ছিল না, তাই দিয়ে ফেললাম। এটাও একটা অত্যন্ত ভয়ংকর অভ্যাস বটে, কিন্তু সে প্রসঙ্গে আরেকদিন বসব, আজ নয়। বালাই ষাট, লিখে যান দাদা দিদিরা, আমার কথায় যেন উত্সাহ হারাবেন না, "শ্রাবনের ধারার মত" কাব্য-চর্চা করে যান। নাহলে যে বাঙালি নামটা আর রাখা যাবে না


1 comment:

  1. হা হা হা হা হা। বেশ বেশ।

    ReplyDelete